মামুনের অণুগল্প: নীল কাব্য

276025

★ এক শীতের সকালে বড্ড উষ্ণ হয়ে আছেন তারিক মোহাম্মদ। ভোরেই খালের পানিতে স্নান সেরেছেন। অনুভূতির গভীর থেকে ক্রমাগত উষ্ণতর এক প্রস্রবণে ভেসে বেড়ানোর রহস্য কি ওই স্নানের সাথে জড়িত?

সাড়ে আটটা বাজে। স্কুল ঘরের কাছে আসতেই প্রশ্নটি আবারো মনে এলো। তার এই বয়সে এসে মানুষ শীতল এবং শান্তিপ্রদ এক অনুভবে বিলীন হতে চায়। সেখানে তিনি কেন এক ‘জ্বালাধরা’ অথচ বড্ড কাম্য এবং অনুভূতিতে রস্য, এমন কিছু গোপন ইচ্ছেপালকের ছোঁয়ায় থেকে থেকে তাড়িত হচ্ছেন?

তারিক মোহাম্মদ। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। এক সাধারণ মানুষ। আজ অনেকগুলো বছর এক অজ পাড়াগাঁয় জীবনের অণুগল্পগুলি লিখে চলেছেন।

গ্রামের এক স্কুল ও কলেজের সিনিয়র শিক্ষক। তবে মিলির কাছে তিনি ছিলেন শুধুই তারেক।
ছিলেন? এখন কি নেই? মিলি কোথায়? তিনি সেখানে নেই কেন?

ফারজানা মিলি।
একই বিশ্ববিদালয়ের ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্রী মিলি। যেন পাশের বাড়ির মেয়েটি! বড্ড কাছের মানুষ ছিল তারিকের। আচ্ছা, কাছের মানুষ দূরে কেন চলে যায়? পাশাপাশি এবং কাছাকাছি থাকার মুহুর্তগুলো নিজেরাও কি বড্ড একঘেয়েমির শিকার?

টিচারস রুমে।
নিজের চেয়ারে বসে এলোমেলো ভাবছেন তারিক। বড্ড বর্ণাঢ্য জীবন তার! এইতো বেশ আছি। আমরা মনে মনে যা ভাবি, চেতন-অবচেতনের আরো গভীরেও কি সেই একই ভাবনা বয়ে চলে? তারিক কি আসলেই বেশ আছেন!

নিজের ডেস্ক। হাবিজাবি অনেক কিছুর সাথে অবহেলায় পড়ে আছে এক নীল খাম। অবহেলা না ইচ্ছেকৃত অবহেলার অপব্যবহার? জগতের ভিতর অন্য এক জগত। এক নীল খাম মিলি নামের এক তরুনীর চামড়ার হৃদয়ের সাথে মিশে থাকা সময়ের ঘ্রাণে মিলেমিশে,পরম আরাধ্য এবং চরম অসহ্যকর এক প্রগাঢ় অনুভবে তারিককে বিলীন করে চলে।

কোন্ সময়ের ঘ্রাণ? এই সময় না সেই সময়? কতগুলো সময় পার করলে কাউকে পাওয়া হয়ে ওঠে? তারিক কি সময়ের সাথে চলতে পেরেছিলেন?

শীতের এক বেলা শুরুর সময়, একজন তারিক মোহাম্মদ, বিগত এক দু:সময়ের নীরব পীড়নে একটু একটু কেঁপে উঠেন। দৃশ্যমান চিন্তাজগতে তার মনে হয় শীতের কারণে এমনটি হচ্ছে বুঝি। তবে তার অদৃশ্য চিন্তাজগতে অন্য কিছু মনে হয়। নিজের মস্তিষ্কে এক ‘প্যারালাল অণুচিন্তায়’ আক্রান্ত তারিক, এই মুহুর্তে তার মনের আসল সত্যটি বড় তীব্রভাবে অনুভব করেন। নীল খাম থেকে কিছু কালো হরফ বের হয়ে তাকে আরো নাড়িয়ে দিয়ে হেলিয়ে দিতে চায়। গুটি গুটি কালো অক্ষরগুলো হৃদয়ের তীব্র রক্তক্ষরণে সিক্ত হয়েছিল বুঝি। তাই এমন রক্তলাল অনুভব! প্রখর অনুভবে কষ্টের নিলীমায় ডুবে যেতে যেতে তীব্র ‘সাইনাস পেইনের’ অনুভূতি এনে দেয়।

কষ্টগুলো এতোটা কষ্টময় কেন?
“স্যরি।
অনেক ভাবলাম। তুমি যে জীবন চাইছ, আমি তা মেনে নিতে পারছি না। তোমাকে ছেড়ে যেতে আমার কষ্ট হবে। অনেক অনেক কষ্ট! কতটা তুমি কি বুঝ? বুঝার মাঝেও কিছু কি বাকী রয়ে যায় এখনো তোমার!


তবুও আমাকে যেতে হচ্ছে…।”
মিলির লেখা শেষ চিঠি। আজো সব মনে আছে তারিকের।

ডেস্কের তালা খোলেন। হাতের ছোয়া লাগে নীল খামে। সময়ের ঘ্রাণে তিনি উদ্দীপ্ত হন। এক বিশেষ সময়ে ফিরে যান। এই খামটি মিলি নিজের কালো ব্লাউজের ভেতর থেকে বড্ড নির্বিকার ভাবেই বের করে তাকে দিয়েছিল। ঠিক ওর হৃদয়ের ওপরে মনের বড্ড কাছাকাছি ছিল খামটি। বেশ কিছু সময়।

সে একটি নীল খামও হতে পারল না!!
প্রচন্ড এক আক্ষেপ মহাজাগতিক রশ্মির লেজ ধরে কোন্ সুদূর থেকে হৃদয় পানে ধেয়ে আসে! তারিক কষ্টের সাগরে তলিয়ে যেতে যেতে ভাবেন, মিলির হৃদয়ের কাছে, মনের গোপন দরজাটির কাছাকাছি, কত থাকতে চেয়েছে মন! তবে মিলি বরাবরই কাছে-দূরের মানুষের মত আচরণ করেছে। নারীর স্বভাবজাত রহস্যময়ী আচরণ ছিল কি?

তারিক আজ এতোগুলো বছর পর, দৃশ্যের ওপারের দৃশ্য দেখবার চেষ্টা করেন। মনের ভেতরের মনকে দেখা কিংবা মনের অতল তলে অবগাহনের চেষ্টা কি এতটাই সহজ?

‘মিলির জীবনে আমি একটি নীল খাম হয়েও কিছুক্ষণ থাকতে পারলাম না!’

তারিকের অদৃশ্য চিন্তাজগত এই অনুভূতিতেই পাক খেতে থাকে। তার ‘প্যারালাল চিন্তাজগতের’ অন্যপাশে এক কবির উদয় হয়। একই মানুষের দুই ভূবনের অনুভূতির তীব্রতায় তারিক মোহাম্মদ এবং মিলির তারেক কেঁপে কেঁপে ওঠেন। গ্রামের এক স্কুল ঘরের টিচারস রুমে.. এক শীতের সকালে.. একা একা।

হৃদয়ের রক্তক্ষরণ অক্ষরে রুপ নেয় বড্ড নির্মমতায়। অন্য এক তারিক মোহাম্মদ নীল খামে বেদনার নীল কাব্য লিখে চলেন জীবন ক্যানভাসের পাতায় পাতায়!

‘একটি নীল খাম
আর বিবর্ণ এক চিঠি,
অনেক বসন্তব্যাপী কিছু সুপ্ত অনুভূতির লুপ্ত চেতনায়
বদ্ধ দেরাজে এখনো বিরাজমান।
যদিও ওর বুকে লাঙ্গল চষা যরীন হরফগুলো
এখন লুপ্তপ্রায়।

কবে কোন হৃদয় পুড়েছিল বলে-
ধোঁয়াটে ঘ্রাণে মিশে থাকা
সময়ের ঘ্রাণে আপ্লুত এক নীল চিঠি
এই পড়ন্ত বেলায় এসে এখনো
বুকের গভীরে জ্বালা ধরায়।

নীল খামে নীল অনুভূতি প্রেরণকারিণী,
এখন যদিও বিস্মৃতির অন্তরালে। তবুও
স্মৃতিরা জাবর কাটে দুঃস্বপ্নের রাতকে ঘিরে।
আর বদ্ধ দেরাজে মৃত স্বপ্নরা
আশা জাগানিয়া খেলা খেলে।
নীল খাম নীল কাব্য হয়ে
বেদনার অণুগল্প লিখে চলে।’

স্মৃতির মিনারে দাঁড়িয়ে এক প্রেমিক পুরুষ, এক নীল খামে জীবনের হারানো সুরকে খুঁজে পেতে চান। খুঁজে পাবেন কি?

#নীল_কাব্য_মামুনের_অণুগল্প

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
মামুনের অণুগল্প: নীল কাব্য, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২০-০৩-২০২২ | ১৭:৪৬ |

    মূল্যবান একটি জীবন প্রশ্নের মধ্য দিয়ে অণুগল্পটি সমাপ্ত হয়েছে। অসাধারণ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...